রাকিব হোসেন, অসংখ্য সার্টিফিকেট এবং পরীক্ষার খাতার মাঝেই সীমাবদ্ধ এই নাম। পুরো গ্রাম যে তাকে “তন্ময়” নামে চিনে। বাংলাদেশের অসংখ্য মফস্বল শহরে যেখানে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব, সেখানে তন্ময়ের জন্ম এক ছোট্ট অচেনা গ্রামে, যার নামই দেওয়ানপুর। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছেই। সাথে গ্রামে পড়ালেখাটাকে অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় বস্তু হিসেবেই বিবেচনা করে গ্রামবাসী৷ তবে তন্ময়, এ যুগের ছেলে, এসব চিন্তা বিবেচনা তার মাঝে শোভা পায় না। যেখানে শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়া যেকোনো দেশই অচল, সেটা বিশ্বের বড় – শক্তিশালী কিংবা এককোণের কোনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রই বা হোক। উনবিংশ – বিংশ শতাব্দী পার করে বিশ্ব যে এখন একবিংশতে। তাই ছোটবেলা থেকেই অস্বাভাবিক এক প্রতিভা নিয়েই তন্ময়ের শুরু। বেশিরভাগ শিশুর বিদ্যালয়ের শুরুটা হয় অশ্রুসিক্ত হয়ে। বেশিরভাগই ভাবে যেন কোনো এক অজানা একলা পৃথিবীর দিকে এগিয়ে দিলো তাদের বাবা মা, বেশিরভাগেরই মন থেকে মস্তিষ্ক জুড়ে থাকে ভয়, অজানা এক ভয়। তবে এ স্বাভাবিকতা যে তন্ময়ের মাঝে নেই। অদম্য মেধাবী এবং ব্যতিক্রম শিশু তন্ময়ের মাঝে ছিলো প্রবল আগ্রহ এবং সঠিক চিন্তাভাবনা। তার মনে কোনো ভয় কাজ করেনি। ভাবেনি তার বাবা-মা তাকে কোন জগতে পাঠিয়ে দিলো, অবশ্য বাবা ছাড়া যে তন্ময়ের কেউ ছিলো না, মা নামক মানুষটিকে দেখার কিংবা বোঝার সুযোগটা যে তার হয়নি। গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসা-ব্যবস্থা অনেকটা অনুমেয়। যারা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শিক্ষা-দীক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় বস্তু বিবেচনা করে, তাদের চিকিৎসাব্যবস্থা কেমন হবে, তা যেকোনো বাংলাদেশী বলতে পারবে৷ স্বাভাবিকভাবেই হাসপাতালে তন্ময়ের জন্ম হয়নি। প্রাচীন নিয়মে চিকিৎসা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একজন গর্ভবতী নারীর জন্য, অত্যন্ত পীড়াদায়ক প্রসব-যন্ত্রণা কজনেরইবা সহ্য হয়, তন্ময়ের মায়েরও যে তা সহ্য হয়নি। তাই তন্ময়কে জন্ম দিয়েই তাকে বরণ করে নিতে হয়েছে মৃত্যু। যাই হোক, মাছাড়া বড় হওয়া তন্ময়ের ছিলো না ভয়, ছিলো আগ্রহ। জানার ইচ্ছা ছিলো বিদ্যালয়ে কী কী শেখা হয়। এভাবেই প্রবল জানার ইচ্ছা নিয়েই বেড়ে ওঠা তন্ময়ের। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি সে সহজেই পাস করে, সে শুধু পাস করেনি, তার শ্রেণিতে প্রথমও হয়, শুধুমাত্র প্রথম নয়, দ্বিতীয়স্থান অর্জন করা শিক্ষার্থীর নম্বর এবং তার নম্বরের যে অনেক বড় ব্যবধান থাকে। দেওয়ানপুরের স্কুল থেকে অনেক বেশি শিক্ষার্থী কলেজ-শিক্ষার দিকে আগাতে পারে না, তাদের পাস হওয়ার হার থেকে ঝড়ে পড়ার হারই যে বেশি, তন্ময়ের বাবা অবশ্য তন্ময়কেও কলেজে ভর্তি করাতেন না, কারণ গ্রামে চলমান যুক্তহীন শব্দগুলো যে তাকেও গ্রাস করে, তিনিও বিশ্বাস করেন কৃষকের ছেলে কৃষক হবে, জেলের ছেলে জেলে, এতো পড়াশুনা করে হবেটাই বা কী৷ কিন্তু তন্ময় যে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, ছেলের জেদের কাছে হার মানতে তাকে হলোই। শহরের মোটামুটি নামকরা ও ভালো কলেজেই ভর্তি করানো হলো তন্ময়কে। ক্লাসের প্রথমদিন থেকে যে কী অপেক্ষা করছে তা খোদ তন্ময়ও হয়তো ভাবেনি। স্কুলজীবনের আরম্ভের মতোই হবে যাত্রাটা। অনেকের জন্যই হয়তো এভাবেই হয়, জানার আগ্রহ নিয়ে, শেখার মন্ত্র নিয়ে। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকে শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয়, নাম-ধাম জিজ্ঞেস করলো, অত্যন্ত স্বাভাবিকই এটি। ধারাবাহিকভাবে সবাই বললো, ক্লাসে একজনের নাম ফাহাদ ইকবাল, পড়ালেখায় অতোটা ভালো নয়, তবে তার পিতা শহরের নামকরা ডাক্তার, কলেজের মোটামুটি সব শিক্ষকই ওনার কাছে নানান সমস্যায় যান, ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষকটিও ব্যতিক্রম নন, নামকরা ডাক্তারের ছেলে শুনেই তার চোখে মুখে চমক এবং আলাদা এক স্নেহ এসে গেলো। একটু পর দেখা গেলো আরেক শিক্ষার্থী আবীরের সাথে তার কথাবার্তা চললো তুলনায় অনেকটুকু দীর্ঘ, আবীর মোটামুটি ভালোই জানে,মেধাবী তো বটেই, অবশ্য কথোপকথন দীর্ঘ চলার কারণ সেটি নয়, আবীরের পিতা যে অন্য আরেকটি স্বনামধন্য কলেজের শিক্ষক, অত্যন্ত গুরুত্ব ও সম্মানের সাথেই তাদের কথাবার্তা হলো, একসময় তন্ময়েরও সুযোগ এলো। তন্ময়ের নাম জিজ্ঞেস করাতে সে তন্ময় বলেই জবাব দিলো, পুরো নাম জিজ্ঞেস করাতে পরে অগত্যা তার রাকিব হোসেন নামটি বলা লাগলো, তন্ময় ভেবেছিলো তার ফলাফল এবং কঠিন কিছুই জিজ্ঞেস করবেন শিক্ষক, যার উত্তর হয়তো সে দিতে পারবে না। তবে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো তার পিতার পেশা নিয়ে সে বললো, “আমার আব্বা একজন কৃষক”। উত্তর দিতেই সে দেখলো ক্লাসের বেশিরভাগই তাকিয়ে আছে তার দিকে, অনেকে তো হাসাও শুরু করলো, শিক্ষকটি কঠিন মুখ করে অন্য শিক্ষার্থীর কাছে চলে গেলো, তন্ময় এই কঠিন মুখের অর্থটা ঠিকই ধরতে পারলো, সে ভাবলো পিতার পেশাকে অসম্মান করা এরকম দুএকজন তো থাকবেই, তাতে কিছু যায় আসবে না। দুঃখজনক তবে সত্য পরবর্তী দিনগুলো তন্ময়ের কঠিন গেলো, তার সহপাঠীরা তাকে বিদ্রুপ করতে লাগলো, শিক্ষকেরা গুরুত্ব দিতো না যথেষ্ট মেধা থাকা সত্ত্বেও। একবছরেই তন্ময়ের চিন্তাভাবনায় একটি বড় পার্থক্য এসে গেলো, কলেজে যাওয়ার জন্য সে কোনো আগ্রহবোধ করলো না, তবে সত্যটা হচ্ছে রসিকতার পাত্র হওয়ার স্বাদটি যে অত্যন্ত কুৎসিত। দিনের পর দিন সে কলেজে যাচ্ছে না, প্রাইভেট পড়ার কিংবা কলেজ পরিবর্তন করার সামর্থ্যটা তার ছিলো না, তার জীবনে যে সে অভাব-অনটনের মুখোমুখি হচ্ছে। তাই পড়ালেখায় সে অনেকটাই পিছিয়ে পড়লো। দিনের পর দিন অনুপস্থিতিতে কলেজের অনেকটুকু পাঠ তার চুকে গেলো, ছেলের অনাগ্রহে অগত্যা বাবা জমিতে কৃষকের কাজেই যোগ দিতে বললেন। তন্ময়ও না করেনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য সে বাবাকে কম যন্ত্রণা দেয়নি। এভাবেই কৃষক হয়েই দেওয়ানপুরের মাঝে সীমাবদ্ধ থেকে গেলো অসংখ্য স্বপ্ন দেখা তন্ময়। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিলো তার, সেটা তো সম্ভব হয়নি, সাথে প্রতিষ্ঠিত হতেও পারেনি সে, বাবার অভাব অনটন দূর করতে পারেনি, পারেনি কিছুই।
এতে দায় কার? তন্ময়ের সহপাঠীদের? নাকি শিক্ষকের। দায় এদের মধ্যে কারোরই নয়, দায় সমাজ নামক জায়গায় বাস করা মানুষরূপে নষ্ট চিন্তাভাবনার অধিকারীদের। যারা “কৃষক”,” জেলে” দের অসম্মান করে। এখানে শুধু তন্ময়েরই স্বপ্ন ভাঙেনি, কৃষক জেলেদের অসম্মান করা হয়েছে, যেখানে একজন কৃষক ছাড়া আমাদের খাদ্যের যোগান দেওয়ার কেউ নেই, একজন জেলে ছাড়া আমরা অতিসুস্বাদু মাছ গুলো কী খেতে পারতাম?
দিনের পরিক্রমায় সমাজের মানুষদের চিন্তাভাবনা, মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে কিছুটা৷ তবে এসব মানুষিকতা সমাজ থেকে উপড়ে ফেলায়ই যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত।