সে এসেছিল- মোঃ ইসকান্দার ইব্রাহীম (এস.এস.সি ব্যাচ-২০২৩)

একবছর আগের ঘটনা। সেদিনটাও ছিল এমনই একটা মেঘলা দিন। সকাল বেলা বেড়িয়েছিলাম বাড়ি থেকে। অফিসে কিছু কাজ সেরে প্রথমে গেছিলাম সুকিয়া পোখরি। সেখানে একটি টি এস্টেটে কিছু অডিটের কাজ সেরে দুপুর দুপুর রওয়ানা দিয়েছিলাম লামাহট্টের পথে।

ভালোই যাচ্ছিলাম। কিন্তু বিধাতার বোধ হয় অন্যরকম কিছু ইচ্ছে ছিল। ঘন্টাখানেক চলার পরই বিপত্তি ঘটলো।

রাস্তায় গাড়িটা আচমকা একটা ক্যাঁচ করে শব্দ করে বরাবরের মত গেল থেমে। ব্যাস আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়গুলোর মাথায় তখন সন্ধ্যে নামছে। দুপাশে পাইনের জঙ্গল, গভীর খাত। অনেক নিচে সরু নীল সুতোর মত তিরতির করে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী ।

ড্রাইভার ডুগ্গু বেশ অভিজ্ঞ । সেও দেখলাম বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। জায়গাটা একদমই জনবিরল। এদিকে বেশ জাঁকিয়ে বসছে চারপাশে ঘিরে ধরা

অন্ধকারটা। কুয়াশার কারণে দৃশ্যমানতাও বেশ কমে এসেছে।

খানিকবাদে ড্রাইভার যখন দেখলো গাড়ি আর ঠিক হবার কোনো আশা নেই, তখন বলল -” মেমসাব, আপনি গাড়িতেই বসুন। বেরোবেন না একেবারেই। লক করে রাখুন দরজা। আমি দেখি যদি সামনে কোনো বাইকওয়ালা পাই। সামনে গ্যারাজ আছে একটা । সেখান থেকে একজন মেকানিক ধরে আনতে হবে। একটু সময় লাগবে।” আমার তখন সম্মতি দেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।

ড্রাইভার চলে যেতেই আমি আরো একলা হয়ে পড়লাম। অফিসে ব্যপারটা জানাবো ভেবে ফোন বের করে দেখলাম কোনো টাওয়ার নেই ফোনের। চার্জও প্রায় নেই বললেই চলে। অগত্যা চুপ করে বসে থাকা আর ইষ্ট নাম জপ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

এই করেই কেটে গেল বেশ খানিকটা সময়। ততক্ষনে গাড়িতে বসে বসে কেমন যেন ঝিমুনি এসেছে একটা। এমন সময়েই মনে হলো দুটো চোখ যেনো জানলার বাইরে উকিঝুকি দিচ্ছে। চমকে উঠে বসলাম। নিজের অজান্তেই গলা দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো – “কে?”

কাঁচের বাইরে সে শব্দ না পৌঁছনোরই কথা। কাঁচের গায়ে লেগে থাকা বাষ্প হাতের তালুতে মুছে নিতেই হেড লাইটের আলোতে মুখটা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সেই মুখ ভর্তি অসংখ্য বলিরেখা, সাদা দাড়ি গোঁফের জঙ্গল মুখ জুড়ে। অথচ চোখ দুটো শুধু তার মধ্যে যেনো অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল। মাথায় একটা বিচিত্র বর্ণের পাহাড়ি টুপি। সে যেন আমাকে কিছু বলতে চাইছে। আমি তখনও বুঝে উঠতে পারছি না, কাঁচ নামানো উচিত হবে কিনা। অজানা বিপদের আশঙ্কায় অবশ হয়ে আসছিল হাত পা।

ড্রাইভার এই পথে প্রায়ই যায়। সে আমাকে পইপই করে বলে গেছে কোনো অবস্থাতেই জানলার কাঁচ না নামাতে বা দরজা না খুলতে। নেকড়ের উৎপাত লেগেই থাকে। আবার অনেক সময় মানুষের বেশেও বিপদ ওত পেতে থাকে।

আমি তাই গাড়ির মধ্যে বসেই বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম দেহাতি মানুষটি কি বলতে চাইছেন। একবার মনে হল চারপাশে তো কোনো পাহাড়ি বস্তি বা জনবসতি নেই। এই বয়স্ক মানুষটি কোথা থেকে এলেন ? কোনো অশরীরী নন তো?আর সেটা মনে হতেই যেন ঠান্ডা হয়ে এলো হাত পা।

ততক্ষনে দেখলাম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বাইরে আর সেই সাথে তীব্র ঝড়ো হাওয়া। সামনের কাঁচে ওয়াইপার ব্লেড দুটো নিজে থেকেই হাওয়ার ধাক্কায় চলতে শুরু করল। সেই সাথে দুলে দুলে উঠতে লাগলো গাড়িটা। আমি মনে মনে আকুল হয়ে ডাকতে লাগলাম ভগবানকে। মাঝে মাঝে খুব রাগ হতে লাগলো গাড়িটার ওপর। খারাপ হওয়ার সময় পেল না আর! নিজেকে স্বান্তনা দিলাম এই ভেবে যে পাহাড়ের বৃষ্টি স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ। বেশিরভাগই উড়ো মেঘের বৃষ্টি। তারপর আবার অস্থির হয়ে উঠলাম ড্রাইভার কখন আসবে সেই ভেবে।

ভাবতে ভাবতে আবার চোখ গেলো জানলার বাইরে। আর কি আশ্চর্য এত ঝড়ের মধ্যেও লোকটা সেই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু দাঁড়িয়ে নেই, দু হাত দিয়ে জানলায় ধাক্কা মারছে। পাগলের মত মাথা ঝাকাছে। কি চায় সে আমার কাছে? এই দুর্যোগে এমন করে কাউকে কি করে ভিজতে দেই? ড্রাইভার যাই বলে যাক, মানুষ হয়ে এ কাজ সম্ভব নয়। কপালে যা আছে ভেবে, পাল্লাটা নামালাম একটুখানি আর সাথে সাথে ঝাপিয়ে পড়লো জানলার বাইরে এতক্ষণ অপেক্ষা করে থাকা একরাশ বৃষ্টি ভেজা দমকা হাওয়া।কিন্তু সে কোথায় ? বাইরে তো কেউ নেই! হাওয়ায় মিলিয়ে

গেল নাকি। সেও কি সম্ভব! ভয়ের চোটে আবার তুলে দিলাম জানলা।

ততক্ষনে ভিজে গেছি একপ্রস্থ। গাড়ির সিট, তোয়ালের হালও তথৈবচ। জানলা তুলে দিয়েও লোকটাকে দেখতে পেলাম না আর। ভাবলাম হয়ত চলে গেছে। হাওয়ার বেগ কিন্তু বাড়লো আরো। বুঝলাম ড্রাইভার তাড়াতাড়ি না এলে প্রাণ বাঁচানো দায় হবে। গাড়ি যদি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাওয়ার ধাক্কায় ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামতে শুরু করে তবে মৃত্যু অনিবার্য।

আমি এবার এত শীতেও ঘামতে শুরু করেছি। হঠাৎ মনে হল, কে যেন হাওয়ার বিপরীতে গাড়িটাকে ঠেলে ওপরের চটিতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শিরদাঁড়া দিয়ে কিসের যেনো একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। একবার মনে হল, যা হচ্ছে হোক। গতি আরেকটু বাড়লে নয়, দরজা খুলে ঝাঁপ দেবো। যা থাকে কপালে। তারপর কি ভেবে পেছন ঘুরে তাকাতেই ব্যাক লাইটের আলোয় দৃশ্যটা দেখেই শিউরে উঠলাম। এ তো সেই মানুষটা। সমস্ত প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে আমার গাড়িটা ঠেলে তুলছেন ওপরে।

তবে অবাক হওয়ার বাকি ছিল আরো। গাড়িটা একটু এগিয়ে যেতেই বৃষ্টির বেগও কমল খানিক। হাওয়ার দাপটও সেই সাথে কমল। আমি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকিয়ে দেখলাম দূর থেকে একটা জোরালো হেড লাইটের আলো অন্ধকার চিরে এগিয়ে আসছে।

বুকে জল এলো দেখে। কেনো জানি না মনে হল, হয়ত বেঁচে গেছি এ যাত্রা। গাড়িটা এগিয়ে আসতে দেখলাম, সেটা একটা বাইক। বাইক থেকে আমার ড্রাইভার আর আরেকজন লোক নামলো। ড্রাইভার ছুটতে ছুটতে এসে বলল -” ম্যাডাম, আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। আপনাকে যেখানে রেখে গেছিলাম সেখানে তো ধস নেমেছে। রাস্তায় খবর পেলাম। আমি ভাবিনি আপনি গাড়ি নিয়ে এতটা এগিয়ে আসতে পারবেন। আপনাকে ফোনেও পাচ্ছিলাম না। ” আমার মুখ দিয়ে শব্দ সরল না।

শুধু দুচোখ দিয়ে তখনও আতিপাতি করে খুঁজছি সেই মানুষটাকে, যে আজ আমাকে প্রাণে বাঁচালো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *