হুমায়ুন ফরিদী – রাজ বড়ুয়া (এস.এস.সি ব্যাচ-২০২৩)

হুমায়ূন ফরীদি (২৯ মে ১৯৫২ – ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২) অভিনেতা ও নাট্য সংগঠক। হুমায়ূন ফরীদি ১৯৫২ সালের ২৯ মে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া ইউনিয়নের চুয়ারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এটিএম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তিনি নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর মাদারীপুর ইউনাইটেড উচ্চবিদ্যালয় হতে ১৯৬৮ সালে এসএসসি এবং চাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাস করেন। হুমায়ুন ফরীদি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পিতার কর্মস্থল চাঁদপুরে অবস্থান করেন। স্বাধীনতার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি হন। স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন এবং নাট্যোৎসবের প্রধান আয়োজক হিসেবে কাজ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল-দীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্যপদ লাভ করেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে বাঙালির নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক গঠনে গ্রাম থিয়েটারের ভূমিকা অসামান্য। এর মূল সঞ্চালক ছিলেন কয়েকজন নাট্য ব্যক্তিত্ব যেমন সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, আফজাল হোসেন, গোলাম মোস্তফা, পিযূস বন্দোপাধ্যায়, সুবর্ণা মোস্তফা এবং হুমায়ুন ফরীদি। ঢাকা থিয়েটারে ভূত নাটক নির্দেশনার মাধ্যমে মঞ্চ নাট্যধারায় অভিষেক ঘটে। বাংলাদেশে যখন নাট্য মঞ্চের সংকট তখন তিনি মহিলা সমিতি এবং গাইড হাউজ থেকে মঞ্চনাটকে অভিনয় চালিয়ে যান। বেশ কিছু মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর অভিনীত মঞ্চ নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শকুন্তলা, কির্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি এবং ফণীমনসা, ধূর্ত উইঁ। মঞ্চনাটককে প্রসারিত করার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন নাটক কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও গ্রাম থিয়েটার এর অন্যতম। ফরীদি ১৯৮৪ সালে তানভীর মোকাম্মেলের হুলিয়া স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।[৫] পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে শেখ নিয়ামত আলীর দহন (১৯৮৫) চলচ্চিত্র দিয়ে। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরীদির অভিষেক ঘটে নিখোঁজ সংবাদ নাটকের মধ্যদিয়ে। এরপর নীল নক্সার সন্ধানে (১৯৮২), দূরবীন দিয়ে দেখুন (১৯৮২), ভাঙ্গনের শব্দ শুনি (১৯৮৩), বকুলপুর কত দূর (১৯৮৫), দু’ভুবনের দুই বাসিন্দা, একটি লাল শাড়ি, মহূয়ার মন (১৯৮৬), সাত আসমানের সিঁড়ি (১৯৮৬), একদিন হঠাৎ (১৯৮৬), চান মিয়ার নেগিটিভ-পজেটিভ (১৯৮৬), ওযাত্রা (১৯৮৭), সংসপ্তক (১৯৮৭-৮৮), পথের সময় (১৯৮৯), দুই ভাই (১৯৯০), শীতের পাখি (১৯৯১), কোথাও কেউ নেই (১৯৯০), সমুদ্রের গাঙচিল (১৯৯৩), তিনি একজন (২০০৫), চন্দ্রগ্রস্ত (২০০৬), কাছের মানুষ (২০০৬), মোহনা (২০০৬), ভবের হাট (২০০৭), শৃংখল (২০১০), প্রিয়জন নিবাস (২০১১), আরমান ভাই দি জেন্টলম্যান (২০১১) ইত্যাদি নাটকে সফল অভিনয় করেন। এর মধ্যে সংসপ্তক নাটকের কান কাটা রমজান চরিত্রটি ফরীদিকে বাঙলা নাট্যামোদী দর্শকের কাছে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। তিনি টেলিভিশন নাট্যাভিনয়ের প্রথাগত ধ্যান ধারণা ভেঙ্গে সৃষ্টি করেন এক নতুন অভিনয় ধারা। ২০০৪ সালে ফরীদি দুটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, সেগুলো হল হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া ও তৌকীর আহমেদের জয়যাত্রা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই বছর তিনি মাতৃত্ব চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি একাধারে আর্ট ফিল্ম এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। আর্ট ফিল্মে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হুলিয়া, ব্যাচেলর, আহা, মাতৃত্ব, বহুব্রীহী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া ও একাত্তরের যিশু। তাঁর অভিনীত বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেলখযোগ্য হলো দহন, সন্ত্রাস, বিশ্বপ্রেমিক, ত্যাগ, মায়ের মর্যাদা, অধিকার চায়, মায়ের অধিকার, ভন্ড, রিটার্ন টিকেট, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, দূরত্ব, পদ্মানদীর মাঝি ইত্যাদি। হুমায়ুন ফরীদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে অতিথী শিক্ষক হিসেবে অভিনয় বিষয়ে কিছুদিন পাঠ দান করেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ধানমন্ডিতে তার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। এর পূর্বে তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়ায় তাকে ঢাকার মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসার পর তিনি ১৩ ফেব্রুয়ারি বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। এই আঘাতেই তার মৃত্যু হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *