মায়া, প্রত্যয় চৌধুরী, এসএসসি ২০২২


অনিরুদ্ধ চট্টগ্রামে এসেছে দু’বছর হয়ে গেল।এবার কলেজের শেষ বৎসর। কিন্তু কেমন যেন এই শহরের মানুষজনদের চেনে উঠতে পারেনি।
সবাই যেন নিজেদের মধ্যেই থাকে। কেউ কারোর আপন নয়।কথায় আছে না? “গরজ বড় বালাই”,এখানের জন্য এটি একদম খাঁটি কথা। একজন ছাত্র হোস্টেলে থাকে,কলেজের প্রথম দিন থেকেই এখানে থাকে,তার রুমমেট ‘ ‘। ছেলেটির নাম ঈশ্বরচন্দ্র ভৌমিক।
সত্যিকারের ঈশ্বরচন্দ্রের মতো পড়ালেখায় দক্ষতা না থাকলেও,গিটারের হাত ভালোই আছে।
তেমন কথাবার্তা হয়না ছেলেটির সঙ্গে।সকালে বের হয় আর রাতে ফিরে আসে।খুব একটা মিশুক নয়।
অনিরুদ্ধও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।কলেজের শেষের দিকে পড়ার চাপটা একটু বেশিই।

আজ সকাল ৮টায় বাংলা পিরিয়ড। অনিরুন্ধ ছটপট নাস্তা করে বের হয়ে গেল কলেজের উদ্দেশ্যে। কলেজের বাংলা প্রফেসরের নাম নীশু চৌধুরী। কলেজের প্রফেসরদের সাথে বিশেষ পরিচয় অনিরুদ্ধের নেই বললেই চলে।শুধু ক্লাসে দেখা।
কিন্তু এই বাংলা স্যার অনিরুদ্ধর ভিষণ প্রিয়।তার পড়ানোর ধরণ যেন গল্পের প্রতিটি চরিত্রকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন।স্যারটির মধ্যে আলাদা ক্ষমতা আছে যায় মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন।
অনিরুদ্ধর কলেজে বন্ধুবান্ধব বলতে গেলে দু-একজন।তার একটি সমস্যা হলো সে খুব সহজে কারোর সাথে মিশতে পারেনা।তবে অনিরুদ্ধ বেশ ভালো বিতর্ক পারে।স্কুল জীবনে কয়েকবার জেলা পর্যায় পুরুষ্কার পেয়েছে। কলেজে এসেও সে বসে থাকেনি।সাংস্কৃতিক সংঘটনের সাথে যুক্ত হয়েছে।সামনের মাসেই সেই সংঘটনের বর্ষপূর্তি। যার জন্য অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।তাছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।ক্লাস শেষে যখন অনিরুদ্ধ কম্পাউন্ডে আসলো,তখন দিগন্তের সাথে দেখা হলো।সাংস্কৃতিক সংঘটনের সভাপতি সে।অনুষ্ঠানের সব দায়িত্ব তার উপর।তিনি হাত নেড়ে অনিরুদ্ধকে কাছে ডাকলেন।
“কেমন আছো?” অনিরুদ্ধকে বলল।
“এইতো ভালোই আছি, আপনি?”” একটু ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছি।থাক এসব কথা,তোমাকে যে কারণে ডেকেছি।তুমি কি আগামীকাল একটু সময় দিতে পারবে?”
“পারবো মনে হয়,তেমন গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস নেই,কিন্তু কেন??”
বলছি,কলেজে এবার যারা নতুন এলো,তাদের ক্লাসে গিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানাতে হবে।আর তারা যদি চায় তবে তারা আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করতে পারবে।তোমার সাথে আর দুজন থাকবে।হিমাদ্রী আর অর্পিতা।
১০টায় এখানে চলে এসো।”
“আচ্ছা, নমষ্কার।” অনিরুদ্ধ বলল।

অনিরুদ্ধ ক্লাস ফাকি তেমন একটা দেয় না। দিগন্ত কেন যে তাকেই বেছে নিল, বুঝে উঠতে পারল না সে।অনিরুদ্ধ ও হিমাদ্রি চলে এসেছে যথাসময়ে। অর্পিতা এখনো আসে নি। অনিরুদ্ধের মনে হলো , মেয়েদের যেকোনো কাজে দেরি করার একটি প্রচলিত প্রথা রয়েছে। প্রায় পনেরো মিনিট অপেক্ষার পর অর্পিতা এলো। তারা তিনজনে লিফলেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পরপর কয়েকটি ক্লাসে জানিয়ে দিল। তাদের মধ্যে অনেকজনই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক। এখন তারা আরেকটি ক্লাসের সামনে এসে দাড়াল। এটাই শেষ ক্লাস অনিরুদ্ধ প্রথমে ঢুকে ম্যাডাম এর কাছ থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নিল। তারপর বলল,’ একজন মানুষের পড়ালেখার পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত থাকা উচিত। এই বিষয়টি সকলের কাছে পৌঁছাতে, আমরা আগামী ১৭ই জুলাই, সোমবার আমাদের কলেজ কম্পাউন্ডে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি।তোমাদের মধ্যে কেউ যদি আমাদের সাথে এই কর্মকান্ডে যুক্ত হতে চাও, তাহলে আমাদের জানাতে পার।’ এই বলে যখন অনিরুদ্ধ সামনের ছাত্র-ছাত্রী’দের দিকে দেখল, তখনি যেন তার মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে শীতল ছোয়া বয়ে গেল। কলেজ জীবনের শুরু থেকেই অনেক মেয়েকেই দেখেছে, যাদের সুন্দরী না বললে পাপ হবে। কিন্তু ঐ চোখজোড়ার মত মায়া কারো চোখে লক্ষ্য করে নি। যে মায়ার সাগরে একবার ডুব দিলে ক্রমশ গভীরেই তলিয়ে যেতে হয়, উঠে দাড়ানোর শক্তি কেউ পাবে না আর। অনিরুদ্ধের মনে হলো, সেই চোখের মায়ার ঘোর লেগে গেছে তার।নেশাগ্রস্ত মানুষেরা যেমন চারপাশের কিছু বুঝে উঠতে পারে না,অনিরুদ্ধের ঠিক একই অবস্থা হল। এমন মুহুর্তে মেয়েটি উঠে দাড়িয়ে হাত তুলে বলল,’ আমি আপনাদের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চায়। অনিরুদ্ধ বলল,’তোমার নাম?’
সে বলল,’অবর্ণি চৌধুরী।’ মেয়েটির নাম খাতায় তুলে, অনিরুদ্ধ’রা ফিরে এলো। তবে ঐ দুচোখের নেশা যেন এখনো কাটছে না তার।সারাক্ষণ শুধু মেয়েটির মুখটা ভেসে উঠছে। রাতে ঘুমোতে যাওয়া কিনবা সকালে ঘুম থেকে উঠা, প্রথমেই মেয়েটির মুখটাই ভেসে উঠে চোখে। অনিরুদ্ধ যেন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই দুবছরে যে ছেলে কোনো মেয়ের সাথে ভালমত কথা বলতে পারেনি, সেই ছেলেটাও কারো প্রেমে পড়তে পারে! অনিরুদ্ধ যেন মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবে, ভালোবাসা আর ভালোলাগা তো একি নয়। ভালোলাগা শুধু ক্ষণিকের জন্য স্থায়ী কিন্তু ভালোবাসা তো চিরকাল রয়ে যায়, কোনোসময় প্রকাশ্যে আবার কোনোসময় গোপনে।

গতকাল অনিরুদ্ধ বাড়ি গিয়েছিল।তার মায়ের জন্মদিন ছিল।আবার আগামী কাল তাদের কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকায় তাকে চলে আসতে হয়েছে। প্রথম প্রথম বাড়ি থেকে ফেরত আসতে ভিষণ মন খারাপ হত, কেননা সে আগে কখনোই পরিবার ছাড়া থাকে নি কোথাও। এখনও কষ্ট যে হয় না তা নয়,তবে আগের মতন না।মানুষের সময়ের সাথে সাথে সবকিছুর কি অভ্যেস হয়ে যায়? অনিরুদ্ধ যে কাজই করুক না কেন,অবরনির মুখ যেন সে ভুলতে পারছে না।তাকে পিছু করে বেড়াচ্ছে।
সকাল ১১ টায় অনিরুদ্ধ কলেজ কম্পাউন্ডে আসল।গতকাল অনেক সময় নিয়ে ভেবেছে সে,কখনো কোনো মেয়ের রুপে সে এমন ভাবে আটকা পড়ে নি।অবরণির মধ্যে সবার থেকে ভিন্ন কিছু রয়েছে।
তার চোখ জোড়া যেন পুরনিমার চাঁদ, অপলক দৃষ্টিতে সেইদিকে দেখে থাকা যায়। সে ঠিক করল আজ অবরনি কে তার মনের কথা বলবে।কিছুটা মানসিক প্রস্তুতিও
নিয়ে এসেছে সে।
অনিরুদ্ধ অবরনির কাছে গিয়ে বলল,’তুমি আজ কি উপস্থাপন করবে?’ সে বলল,’কবি জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন।’ অনিরুদ্ধের মনে হলো যেন বনলতা সেন তার সামনে দাড়িয়ে আছে। বনলতা সেন’র সৌন্দর্যের মহিমা যেন অবর্ণির মধ্যে ধরা দেয়। ক্ষনিকের নিরবতা ভেঙে অনিরুদ্ধ বলল,’তোমার সাথে কিছু কথা রয়েছে। অনুষ্ঠানের পর সময় হবে?’
‘ হ্যাঁ, তবে আমার সাথে কি এমন কথা রয়েছে?’
‘সে না হয় তখনি জেনে নেবে।এখন যাই। অনুষ্ঠানের পর অপেক্ষা কোরো।’
অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় পৌনে চারটা বেজে গেল। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অনিরুদ্ধ এখন অবর্ণির সামনে একটি কফিহাউসে বসে আছে।অনিরুদ্ধ কিভাবে কথাটা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। নিস্তব্ধতা ভেঙে অবর্ণি বলল,’এবার বলে ফেলুন কি কথা রয়েছে। আচ্ছা কফি খেতে খেতে শুনি।’ ওয়েটার কে ডেকে সে দুটো কফি অরডার দিল।এবার অনিরুদ্ধ বলল,’আমি পেচিয়ে কথা বলতে পারি না। সোজাসুজি বলছি।’ একটা বড় শ্বাস নিল সে। বুক ধুকধুক করছে তার। বলল,’ আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি।’ অবর্ণি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অনিরুদ্ধের দিকে। ওয়েটার এসে কফি রেখে চলে গেল। অনেক্ষন তারা চুপচাপ,কেউ কোনো কথা বলছে না। শেষ পর্যন্ত অনিরুদ্ধ বলল,’তোমার মতামত?’ অবর্ণি কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,’সারাজীবন পাশে থাকতে পারবে?’ সে বলল,’ তুমি সাহায্য করলে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত একসাথে থাকব।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।আমার এখন বাড়ি যেতে হবে।’ অনিরুদ্ধ এক টুকরো কাগজে নিজের মোবাইল নম্বর লিখে দিয়ে বলল।’ বাড়ি পৌঁছে কল দিও।’

অনেকটা সময় পার হয়ে গেল।অনিরুদ্ধের ফাইনাল পরিক্ষা শেষ। কলেজে থাকতে অবর্ণির সাথে অনেক্ষন কাটানো যেত। কিন্তু এখন দিনে শুধু একবার দেখা হয়, তাও পনেরো-কুরি মিনিটের জন্য।অনিরুদ্ধের একটা অভ্যেস মত হয়ে গিয়েছে। যতক্ষন না সে অবর্ণি কে দেখছে তার একটা অস্বস্তিবোধ হয়।সকাল থেকে ঐ ১৫-২০ মিনিটের অপেক্ষায় থাকে।সেই সময়টাই যেন দিনের সবচেয়ে ভালো সময়। অবর্ণির সাথে কোন ফাঁকে এক বছর হয়ে গেল, সে যেন বুঝতেই পারল না। কালকে তার মায়ের জন্মদিন, তাকে বাড়িতে যেতে হবে।
একটা দিন সে অবর্ণির মায়াবী চোখগুলো দেখতে পারবে না সে, কেমন যেন তার মন খারাপ হয়ে গেল।
অনিরুদ্ধ আর অবর্ণি এখন ডিসি হিলে বসে আছে। অবর্ণি অনিরুদ্ধের কাধে মাথা রেখে বলল,’কখন আসবে তুমি,অনি?’ সে বলল,’ পরশু সকালে ফিরব।’
‘ বাসে করে যাবে নাকি ট্রেনে যাবে?
সাবধানে যেও কিন্তু!’
‘বাসেই যাব ভাবছি।’
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। কাল পৌঁছে কল দিও।’
অনিরুদ্ধ আর অবর্ণি দুজনেই উঠল, যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু অবর্ণির অনিররুদ্ধকে ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন আর কখনো অনিরুদ্ধকে সে দেখতে পাবে না। তবে চাইলেই কি সব পাওয়া যায়!

অনিরুদ্ধ সকালে উঠে , মায়ের জন্য উপহার কিনল। নতুন ব্রিজে এসে একটি বাসে উঠে পড়ল।অবর্ণির কথা খুব মনে পড়ছে তার। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় অবর্ণি তার সামনে দারিয়ে আছে।অবর্ণির কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, বুঝতেই পারল না সে। ঘুম ভাঙল প্রচন্ড চিৎকারে। চারপাশে কী হচ্ছে বুঝতে খানিক্ষন সময় লাগল। সে দেখল সকল যাত্রী শূণ্যে ভাসছে, একটি দানবাকার ট্রাক নিয়ন্রন হারিয়ে তাদের বাসকে ধাক্কা দিয়েছে। যাত্রী সহ বাস ব্রিজ থেকে নদীতে পড়ে যাচ্ছে। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারল তারা সবাই পানিতে ডুবে যাচ্ছে। সে সাতার ও জানে না।
তার মনে হল, অবর্ণি তার দিকে ছুটে আসছে কিন্তু তাকে ছুতে পাড়ছে না।

অনিরুদ্ধের ব্ন্ধু কাব্য অবর্ণিকে কল করে দূর্ঘটনার খবরটা দিল। অবর্ণির মনে হল যেন তার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। হঠাৎ একটি ঝড় যেন তার থেকে সবকিছু কেড়ে নিল। যে মানুষটা তাকে আগলে রাখত সেই মানুষটা আর নেই ভাবতেই সে আর্তনাদ করে উঠল।তাকে কে বলবে,”রাগ করে থএকো না তো। তুমি কথা না বললে যে আমার শ্বাস কষ্ট হয়।” অবর্ণি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাদতে লাগল। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারল না, অনিরুদ্ধ তার কাছে আর ফিরে আসবে না। তবে কেনো সে অবর্ণিকে বলেছিল,
“মন যেন আমার অসীম আকাশ
সেই আকাশে তুমি মেঘকণ্যা,
ঐ অসীম আকাশ তোমায় দিলাম
সে আকাশ ছেড়ে যেও না।।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *